প্রসঙ্গ তরুণ মজুমদার (সম্পাদক: সুগত রায়) (প্রথম প্রকাশিত ২০২৪)

400.00

ISBN 978-93-95434-06-5 ।
Pages 184 plus 8 pages B&W art plates and 8 pages colour

follow Us

তরুণ মজুমদার অ্যাসিস্টান্ট হিসাবে ঢোকেন কানন দেবীর ইউনিটে । সেখানে হৃদ্যতা হয় দিলীপ মুখার্জি ও শচীন মুখার্জির সঙ্গে । পরে ওঁরা তিনজন মিলে “যাত্রিক” নামে একটি গোষ্ঠী বানিয়ে প্রথম ছবি করেন “চাওয়া পাওয়া”, বহুবন্দিত “পলাতক” প্রথম পর্বের শেষ ছবি । ১৯৬৫তে স্বনামে বাংলা সাহিত্য ভিত্তি করে দুটি ছবি করলেন তরুণবাবু । প্রায় ২৫ বছর ধরে তাঁর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের । বাংলা সাহিত্যভিত্তিক অধিকাংশ ছবি জনপ্রিয় হয়েছে ও তিনি জাতীয় স্তরে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন । তিনি “সংসার সীমান্তে”, “গণদেবতা”, “ফুলেশ্বরী”, “নিমন্ত্রণ”, ইত্যাদি ছবি করেন। আশির দশকে গোড়ায় ” দাদার কীর্তি” বিরাট সাফল্য লাভ করেন।
এই বইতে আছে তরুণ মজুমদারের বহু অগ্রন্থিত লেখা—তাঁর বহু সহকর্মী, অভিনেতা ও অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচালক ও কলাকুশলীদের নিয়ে; লিখেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের নানা বিষয় ও নানা সমস্যা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন । আরও লিখেছেন তাঁর ফুটবল প্রীতি ও বাংলা খাবারের পছন্দের জিনিসগুলি নিয়ে । তেমনি আবার একগুচ্ছ লেখাতে তাঁর পরিচিত অনেকে লিখেছেন তাঁর বিষয়ে । তাঁর বিশিষ্ট লেখা ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ নিয়ে আছে দুটি লেখা—দে পাবলিশার্সের অপু দে লিখেছেন বইটি প্রকাশের নেপথ্যকাহিনী আর বোধ্যা পাঠক পবিত্র সরকার বিশ্লেষণ করেছেন বইটিকে।

 

তরুণবাবু নিজেই নিজের ছবির বিজ্ঞাপন ও পোস্টার তৈরি করতেন । বইয়ের শেষে ১৬ পৃষ্ঠা ছবির মধ্যে আছে কয়েক পৃষ্ঠা রঙিন পোস্টার, কয়েক পৃষ্ঠা সিনেমার বিজ্ঞাপন (যা আগে খবরের কাগজে বেরাতো), ছয়টি ছবির স্থিরচিত্র ও একটি তরুণবাবুর রঙিন ছবি ।

তরুণ মজুমদার

 

সন্দীপ রায় ভূমিকা

আমার দেখা তরুণবাবুর প্রথম ছবি ‘কাচের স্বর্গ’– মনে আছে ‘ভারতী’ সিনেমা হলে দেখেছিলাম। ছবিতে অবশ্য ওঁর নাম ছিল না, ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠির নাম ছিল। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল বাংলা ছবিতে একজন দক্ষ গল্প-বলিয়ে এসেছেন। ছবিতে গানের ব্যবহারও বেশ ভালো লেগেছিল। এর পরে ‘পলাতক’ দেখে দারুণ লেগেছিল। অনুপদা, রুমাদি দুজনের অভিনয়ই চমৎকার, হেমন্তবাবুর সুর খুবই সুন্দর। তরুণবাবুর ছবিতে উনি ওঁর সেরা সুর দিয়েছেন। আর তরুণবাবু ওঁকে কাজে লাগিয়েছিলেন খুব চমৎকারভাবে। ‘পলাতক’-এর পরে তরুণবাবু নিজের নামে ছবি করতে শুরু করেন। ওঁর প্রথম দুটি ছবি ‘আলোর পিপাসা’ ও ‘এতটুকু বাসা’। এর মধ্যে ‘এতটুকু বাসা’ ছিল বেশ জমাট কমেডি ছবি। ‘পলাতক’-এর সময় থেকেই বাবার ইউনিটের বেশ কিছু গুণী সদস্য – যেমন বংশী চন্দ্রগুপ্ত, সৌমেন্দু রায়, দুলাল দত্ত, রমেশ (পুনু) সেন, ভানু ঘোষ – এঁরা তরুণবাবুর সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। এঁরা আমাদের বাড়িতে এলে বেশির ভাগ সময় আমার ঘরেই আড্ডা দিতেন। তখন তরুণবাবুর সঙ্গে কাজের নানান অভিজ্ঞতার কথা বলতেন এবং এঁরা সকলেই তরুণবাবুর নানান গুণের প্রশংসা করতেন।
তরুণবাবু এর পরে নানান ধরণের ছবি করতে থাকেন— ‘নিমন্ত্রণ’, ‘কুহেলি’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ‘সংসার সীমান্তে’। ‘সংসার সীমান্তে’-র শুটিং দেখতে যাবার কথা মনে আছে। রবি চট্টোপাধ্যায় নিষিদ্ধপল্লীর একটা দারুণ সেট বানিয়েছিলেন। সৌমিত্রকাকার মেকআপ করা হতো অনেকক্ষণ ধরে। আর সৌমিত্রকাকা অভিনয় করেওছিলেন খুব ভালো। ছবিটা মুক্তি পাবার সময় বাবা দেখতে গিয়েছিলেন ৷ বাবা দেখে এসে মন্তব্য করেছিলেন, এটাই তরুণবাবুর সেরা ছবি। সত্যি কথা বলতে কী, তরুণবাবুর সব ছবির প্রেস শো-তেই বাবার নিমন্ত্রণ থাকত। বেশির ভাগ সময় আমি বাবার লেজুড় হয়ে যেতাম বলে আমারও ছবিগুলো দেখা হয়ে যেত। আমার মতেও ‘সংসার সীমান্তে” ওঁর সেরা কাজ। ‘নিমন্ত্রণ’ ও ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ আমার বেশ পছন্দের ছবি। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’এ উৎপালবাবুর কমিক অভিনয় দুর্দান্ত। অভিনেতা অভিনেত্রীদের কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা তরুণবাবু অসম্ভব ভালো বুঝতেন। ওঁর চিত্রনাট্যের সংলাপ খুব স্বাভাবিক ও সাবলীল। সৌমিত্রকাকার কাছে শুনেছি বাবার মতো ওঁরও চিত্রনাট্যের খাতায় নানারকম স্কেচ করে রাখার অভ্যাস ছিল, এবং সেই স্কেচগুলি বেশ সুন্দর। ওঁর সব ছবিতেই একটা আটপৌরে বাঙালিয়ানা থাকত। সেই সময়কার বাংলা ছবি করিয়েরা যেমন তপন সিংহ, অজয় কর, অসিত সেন – সকলেই দক্ষ পরিচালক তো ছিলেনই, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন। তরুণবাবু এই গোত্রেরই একজন মানুষ ও পরিচালক। ‘কাঁচের স্বর্গ’ থেকে ‘দাদার কীর্তি – প্রায় দু’দশক ধরে তিনি একই সঙ্গে জনপ্রিয় ও সুন্দর রুচিশীল ছবি তিনি বাঙালি দর্শককে উপহার দিয়ে গেছেন। তাঁর ছবির বিষয়ের মধ্যেও যথেষ্ট বৈশিষ্ট থাকত। অনেক সময় বছরে দুটি করেও ভিন্ন স্বাদের ছবি তৈরি করেছেন। প্রযোজকরা তাঁর ওপর আস্থা রাখতেন কারণ তাঁর ছবি থেকে তাঁরা ভালোভাবেই লগ্নির টাকা ফেরত পেতেন ।
বাবার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো। দুজনেই দুজনকে পছন্দ করতেন। বাবা চলে যাওয়ার পরে রায় সোসাইটি থেকে প্রতি বছর একটি স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। অনেকেই সেখানে বক্তব্য রেখেছেন। ২০১৯-এ বক্তা ছিলেন তরুণবাবু। আশি পেরোনো মানুষটি চমৎকার বক্তব্য রাখেন— এখন পর্যন্ত যতগুলি বক্তৃতা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা। ইচ্ছে আছে সব বক্তৃতাগুলিকে একসঙ্গে করে একটি বই করার। সন্দেশেও তরুণবাবু একাধিকবার চমৎকার সব লেখা উপহার দিয়েছেন। ওঁর প্রকাশিত আত্মজীবনীর ভীষণ প্রশংসা শুনছি চারপাশে। সবদিক থেকেই উনি ছিলেন গুণী, মার্জিত ও সজ্জন এক মানুষ। আমার প্রিয় পাঁচজন বাঙালি পরিচালকের মধ্যে তিনি অবশ্যই থাকবেন। আরেকটা জিনিস যেটা খুব ভালো লাগত, সেটা হচ্ছে ওঁর বেশির ভাগ ছবি জুড়েই এক সুন্দর সেন্স অফ হিউমার থাকত। ছবিতে আবহসংগীতের ব্যবহার ছিল পরিমিত। তরুণবাবু বোধহয় সেইদিক থেকে লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স। উনি চলে যাবার পরে সেইরকম কোনো গুণী ও মার্জিত মানুষ বাংলা চলচ্চিত্র জগতে রইলেন না। এটা আমার ব্যক্তিগত শোক তো বটেই, সকল চলচ্চিত্রপ্রেমী বাঙালির কাছেই এটা একটা বড়ো শোক।
সন্দীপ রায়